Monday, December 22, 2008

সাবধান! লুকিয়ে আছে বিষাক্ত সাপ

ড: তৌফিক চৌধুরী, লস এঞ্জেলেস
রবিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০০৮
সকল রোগেরই কিছু না কিছু উপসর্গ থাকে, যার উপস্থিতি সেই রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে যথেস্ট পূর্বাভাস দিয়ে থাকে। বুদ্ধিমান বা স্বাস্থ্য সচেতন লোক রোগের পূর্বাভাস পেয়েই সতর্কমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করে এবং ভয়াবহ পরিণাম হতে রেহাই পেতে পারে। তেমনি একটি দেশের জাতীয় পর্যায়ে অনেক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সেই দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার বিপর্যয়ের আগমন বার্তা দিয়ে থাকে। অতি সত্বর তা প্রতিহত করার কার্যকরী ব্যবস্থা না নিতে পারলে, সেই জাতির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। সেই দৃস্টিকোণ হতে, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সুস্পস্টভাবে পূর্বাভাস দেয় যে - বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনাকাংখিতভাবে ক্যান্সারজনিত বিপজ্জনক পর্যায়ে উপণীত হয়েছে।

এ পরিপ্রেক্ষিতে স্মরণ করা যায়, ১৯৭৫ সালের পর সামরিক শক্তির বদৌলতে বাংলাদেশের রাস্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারী এক জেনারেল প্রায়ই ইংরেজীতে দম্ভের সাথে বলতেন, যার বাংলা অনুবাদ হলো, "আমি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে তুলবো"। অনেকের অজান্তে সেই উক্তিই বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে ক্যান্সারের বীজ বপন করেছিল। যার বাস্তব রূপ এখন পরিলক্ষিত করা যায়। এতো ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে প্রাপ্ত বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি শহীদদের আত্মা প্রতি মোটেও শ্রদ্ধাশীল নয়। আপামর জনগণের আর্থ-সামাজিক মুক্তির উদ্দেশ্যে যে ধরণের গণমূখী প্রগতিশীল রাজনীতির ধারা প্রবাহিত রাখার প্রয়োজন ছিল, তা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় জাতীয় রাজনীতিতে সামরিক শক্তির হস্তক্ষেপের ফলে। কারণ, প্রথম সামরিক জেনারেলের নিজস্ব রাজনৈতিক দল সৃস্টির প্রক্রিয়ায় মন্ত্রিত্ব বা রাস্ট্রীয় পদমর্যাদা প্রদানের লোভ দেখিয়ে অন্য দলগুলোর নেতাদের প্রলুদ্ধ করার পাশাপাশি অর্থ, অস্ত্র, ও ধর্মকে ব্যবহার করা হয়। যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় জামাতে ইসলামীসহ স্বাধীনতা বিরোধী দলগুলোকে পূনর্জন্ম লাভের সুযোগ দেওয়া হয়।

সেই জেনারেলের রাজনৈতিক দল সৃস্টির প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশী লাভবান হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলো। যে সকল ব্যক্তি ও দলগুলো ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে বর্বর পাক-হানাদার বাহিনীকে গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, বুদ্ধিজীবি হত্যা এবং বাঙ্গালীদের উপর অত্যাচার-নিপীড়নে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছিল, পরবর্তী পর্যায়ে তাদেরকে রাস্ট্রীয় ক্ষমতায় বসানো শহীদদের আত্মার প্রতি কতোটা শ্রদ্ধাশীল? পৃথিবীর আর অন্যদেশে এ ধরণের উদ্ভট ঘটনা ঘটেনি। কোন এক রাস্ট্রপতি যখন বিজয় দিবস এবং স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে লক্ষ লক্ষ শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে জাতির উদ্দেশ্যে উৎকৃস্ট বাণী প্রদান করেন এবং এর পাশাপাশি সেই জাতীয় দিবসগুলোতে স্বাধীনতা বিরোধী খুনীদেরকে রাস্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর মতো নিকৃস্ট মানের কর্ম সাধন করেন, তখন তা হলো উন্নাসিক মানসিকতার চরম নিদর্শন।

স্বাধীনতাবিরোধী গণদুশমনদেরকে রাস্ট্রীয় ক্ষমতায় বসানোর সুযোগ দিয়ে আপামর জনগণের সার্বিক আর্থ-সামাজিক মুক্তির লক্ষ্যে গণমূখী প্রগতিশীল রাজনীতির বিকাশ কখনও সম্ভব নয়। এক কবির ভাষায় বলা যায়- "জাতির পতাকা খামচে ধরেছে পুরানো সেই শকুন"। এখন সেই শকুনের পাশাপাশি রাস্ট্রীয় প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে লুকিয়ে আছে বিষাক্ত সাপ, যাদের বিষাক্ত ছোবলে আপামর জনগণের সুন্দরভাবে জীবনযাপন করার স্বপ্নগুলোর অপমৃত্যু ঘটবে দু:খজনকভাবে। তাই, সে পুরনো শকুন ও বিষাক্ত সাপগুলোকে রাস্ট্রীয় প্রশাসনের প্রতিটি স্তর হতে নির্মূল না করতে পারলে বৈষম্যহীন রাস্ট্রীয় কাঠামোতে শোষণমুক্ত এবং গণমূখী আর্থ-সামাজিক কর্মসূচী বাস্তবায়নের কার্যকরী পথ কখনো উন্মোচিত হবে না।

বিষাক্ত সাপের উপস্থিতির নমুনা
দেশের এক সংকটময় পরিস্থিতিতে ২০০৭ সালের জানুয়ারী মাসের ১১ তারিখে নেপথ্যে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের ফলে জনগণের মনে এক বিশাল স্বস্তি ও আশার সঞ্চার ঘটেছিল। কারণ, পাঁচ বছর যাবত বিএনপি-জামাত জোট সরকারের দু:শাসনে পুরো বাংলাদেশে ভূমিদস্যু, কালোবাজারী, মি: টেন পার্সেন্টের সিন্ডিকেট এবং চরম দূর্নীতিবাজদের এক বিষাক্ত চক্রের নিকট জিম্মি হয়েছিল। অযাচিত ও অযৌক্তিকভাবে রাস্ট্রপতি ইয়াজুদ্দিন আহমদকে তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বানিয়ে ২০০৭ সালের ২২শে জানুয়ারী পূর্বপরিকল্পিতভাবে সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি জামাত জোটকে রাস্ট্রীয় ক্ষমতায় পুনর্বহাল রাখার অপচেস্টার প্রতিবাদে সারা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোটের পিছনে অধিকাংশ জনগণ ঐক্যবব্ধ হন।

বিএনপি-জামাত জোটের অনুগত ড: ইয়াজুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে তত্বাবধায়ক সরকারের অযৌক্তিক কার্যকলাপের জন্য বাংলাদেশে একটি অজানা গৃহযুদ্ধের সম্মুখে উপণীত হয়। তখন নেপথ্যে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপে নি:সন্দেহে বাংলাদেশ একটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হতে রেহাই পায়। ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারীতে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে ভোটার তালিকাসহ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ত্রুটিগুলো স্বীকার করেন। ড: ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্বাবধায়ক সরকার দূর্নীতিবাজ, ভূমিদস্যু, ও মাস্তানদের বিরুদ্ধে সারাদেশ ব্যাপী যে অভিযান চালিয়েছিলেন তা সকল জনগণের সর্বাত্মক সমর্থন লাভ করে এবং জনগণের মাঝে নতুন এক আশার সঞ্চারন হয়। কিন্তু আজ প্রায় দুই বছর পরে পুরো বাংলাদেশ এক অবাঞ্চিত এবং অনাকাংখিত বাস্তবতার সম্মুখীন, যা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। বিএনপি জামাত জোট সরকারের আমল হতে শুরু করে এই তত্বাধায়ক সরকারের আমল পর্যন্ত ধর্মীয় উন্মাদ ও স্বাধীনতাবিরোধী চক্রকে অবাধ প্রশ্রয় দেওয়া হয়। সাম্প্রতিক অনেক ঘটনাবলী তা সুস্পস্টভাবে প্রমান করে:

(১) পল্টনের মোড় হতে পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নেয়া:
পুলিশের কাছ হতে অস্ত্র কেড়ে নেয়াকে যে কোন দেশে রাস্ট্রদ্রোহী হিসেবে গণ্য করা হয়। ঢাকার পল্টনের মোড়ে ধর্মীয় উন্মাদনায় মৌলবাদী চক্র এ কাজটি করেছে। এই রাস্ট্রবিরোধী কাজের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানা যায়নি।

(২) হাটহাজারীতে পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা:
ধর্মীয় উন্মাদদের দ্বারা হাটহাজারী পুলিশ ফাঁড়িতে হামলার ছবিগুলো পত্রিকায় উঠেছে এবং প্রাণের ভয়ে পুলিশদের পালিয়ে যেতে হয়েছিল। এ ব্যাপারটি জাতির জন্য অশনি সংকেত বহন করে। এর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থার কোন খবর জানা যায়নি।

(৩) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নির্যাতন:
একটি সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই তত্বাবধায়ক সরকাররে আমলে যৌথ বাহিনী কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত ৩/৪ জন শিক্ষককে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, যা পাকিস্তান আমলেও করা হয়নি। পল্টনের মোড় হতে পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নেয়া এবং হাটহাজারীতে পুলিশ ফাঁড়িতে হামলার বিরুদ্ধে এই সরকার নিশ্চুপ থাকার পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপর নির্যাতনের ব্যাপারটি তুলনা করা হলে যা প্রতিভাত হয় তা হলো - বর্তমান তত্বাবধায়ক সরকার এবং রাস্ট্রপ্রশাসনে স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী চক্রের একটি সমর্থকগোষ্ঠী দৃঢ়ভাবে অবস্থান করছে, যা বাংলাদেশের জন্য মোটেও মঙ্গলজনক নয়।

(৪) জনকন্ঠের সম্পাদক জনাব আতিকুল্লাহ খান মাসুদের উপর প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা:
জনাব আতিকুল্লাহ খান মাসুদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁর বলিষ্ঠ পরিচালনায় দৈনিক জনকন্ঠ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রগতিশীল গণমূখী চিন্তাভাবনা প্রকাশের অন্যতম প্রধান দৈনিক পত্রিকা হিসেবে সারা বাংলাদেশে জনগণের মাঝে সমাদৃত হয়। একদিকে স্বাধীনতা বিরোধী খুনীদেরকে রাস্ট্রীয় পর্যায়ে আপ্যায়ন করা হয় এবং শীর্ষস্থানীয় ভূমিদস্যু ও দূর্নীতিবাজদেরকে জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়। অন্যদিকে রাস্টপ্রশাসনে স্বাধীনতাবিরোধি ও ধর্মান্ধ মৌলবাদী চক্রের একটি সমর্থক গোষ্ঠীর প্রতিহিংসামূলক আক্রোশের শিকার হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সপক্ষের বলিষ্ঠ কন্ঠ জনাব আতিকুল্লাহ খান মাসুদ।

(৫) বিবেকবর্জিত বিচারকমন্ডলী:
১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত খুনীদের নাম বাংলাদেশের জনগণের নিকট অজানা নয়। আর হাইকোর্টের এই বিচারপতিগণ সেই খুনীদেরকে নির্দোষ ঘোষণা করে বিবেকহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। এটাকে বলে, "বাঙ্গালীকে হাইকোর্ট দেখানো"। বিশেষ করে তাজ্উদ্দীন আহমদের বলিষ্ঠ ও চৌকস নেতৃত্ব ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের বাস্তব রূপ লাভের কোন সম্ভাবনা ছিল না। আর বাংলাদেশে স্বাধীন না হলে এই বিচারকমন্ডলীর অনেকে হয়তো পাকিস্তান আমলে চাপরাশি হওয়ারও সুযোগ পেতেন না। এতে আবারও প্রমানিত হয় যে, বর্তমানে রাস্ট্র প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের একটি সমর্থক গোষ্ঠীর দৃঢ় অবস্থার বিরাজ করছে।

(৬) লালনের ভাস্কর্য অপসারণ:
বিমান বন্দর চত্বর হতে লালনের ভাস্কর্য অপসারণের ঘটনা কোনমতেই ছোট করে দেখ উচিত নয়। যে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল ধর্মের নামে শোষণের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল রাজনীতির প্রবাহে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে, আজ সেই বাংলাদেশের রাস্ট প্রশাসন ধর্মীয় উন্মাদ ও মৌলবাদী চক্রের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ। সেই স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী চক্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলক অপরাজেয় বাংলার ভাস্কর্য ভেঙ্গে দেয়ার হুমকি দিয়েছে। রাস্ট্র প্রশাসনের প্রশ্রয় পেয়ে ২৯শে নভেম্বর সেই ধর্মীয় উন্মাদের দল মতিঝিলে বিমান ভবনের সামনে স্থাপিত বলাকা ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার চেস্টা করে। এই ঘটনাগুলো জাতির জন্য মোটেই শুভ লক্ষণ নয়।

(৭) স্বাধীনতাবিরোধীদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য:
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাক হানাদার কোন এক অন্যতম সহযোগী এবং চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী যখন আদালতে প্রকাশ্যভাবে বলতে সাহস পায় - "আমি নিজেকে রাজাকার বলতে গর্ববোধ করি" এ ব্যাপারে রাস্ট্রীয় প্রশাসন নিশ্চুপ। এতে প্রমানিত হয়, স্বাধীনতাবিরোধী খুনীদের একটি শক্তিশালী সমর্থক বর্তমান রাস্ট্র প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে সক্রিয়ভাবে উপস্থিত। স্বাধীনতাবিরোধী এই ধরণের চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীগণ একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের অন্তর্ভূক্ত হয়ে রাস্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার সুযোগ পায়, যা লক্ষ লক্ষ শহীদদের আত্মার প্রতি দু:খজনকভাবে অপমানজনক। যখন পাক হানাদার বাহিনীকে সক্রিয়ভাবে সমর্থনকারী এবং স্বাধীনতাবিরোধী দল জামাতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দকে প্রকাশ্যে বলতে দেখা যায়- "বাংলাদেশে কোন মুক্তিযুদ্ধ হয়নি" এটা কোনমতেই শুভ লক্ষণ নয়, বিশেষ করে যখন রাস্ট্রপ্রশাসনকে নিশ্চুপ থাকতে দেখা যায়।

(৮) পাচার করা টাকার কোন হিসেব নেই:
১৯৭১ সালের ১১ই জানুয়ারীর পর পত্রিকায় অনেক খবর উঠেছে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের ব্যাপারে। রাস্তার এক ফালতু লোক পাঁচ বছরে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে একটি ব্যাংক কেনার সৌভাগ্য লাভ করে। খাম্বা ব্যবসা করে শত শত কোটি টাকা লুটপাট করা, একটি বিশেষ ভবনের মাধ্যমে মি: টেন পার্সেন্ট দ্বারা হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের খবর। অসাধুপায়ে অর্জিত এবং পাচারকৃত হাজার হাজার কোটি টাকা উদ্ধারের ব্যাপারে এই তত্বাবধায়ক সরকারের প্রতিশ্রুতিতে আপামর জনগণ আনন্দিত হয়েছিলেন একটি ভাল পরিবর্তনের প্রত্যাশায়। আজ দুই বছরের মাথায় রহস্যজনকভাবে অবৈধভাবে পাচারকৃত হাজার হাজার কোটি টাকা উদ্ধারের ব্যাপারে এই সরকার নিশ্চুপ। অনেকের ধারণা, এটাকে বলে "চোরের উপর বাটপারী" এবং তদন্তকারী ও রাস্ট্রপ্রশাসনের অনেকে হয়তো অবৈধ উপার্জিত হাজার হাজার কোটি টাকার ভাগ পাওয়ায় সেই দূর্নীতিবজার বৈধতা লাভ করে রাজনীতিতে ফিরে আসার সুযোপ পায়। এটি জাতির ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়।

সত্যের মুখোমুখি:
যারা চোর ডাকাত, খুনী, দূর্নীতিবাজ বা অপরাধী তারা সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পায়। সত্যকে চাপা রেখে ভবিষ্যতের ভিত্তি কখনও শক্তিশালী করা যায় না। ভুল ত্রুটি মানব জীবনে চলার পথে একটি স্বাভাবিক অংশ। কিন্তু ভুল ত্রুটি বা অপরাধ ধামাচাপা দেয়ার প্রবণতা মারত্মকভাবে ক্ষতিকর। আজ অনেকে বক্তব্যে শুনা যায় - "৩৭ বছর পূর্বে যা ঘটেছে তা নিয়ে এখন দেশে বিভক্তি আনার প্রয়োজন নেই"। যারা এ ধরণের বক্তব্য রাখেন তারা মূলত: স্বাধীনতার বিরোধীদের সমর্থক। ১৯৭১ সালে যা ঘটেছে তার অবিকৃত ইতিহাস নতুন প্রজন্ম এবং পুরো জাতিকে জানানো একান্ত প্রয়োজন।

সত্যের মুখোমুখি হওয়ার প্রসঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি'র চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে জনসম্মুখে সুস্পস্টভাবে বলতে হবে- কোনটি তার সঠিক জন্ম তারিখ? বিভিন্ন দলিলের সূত্র অনুযায়ী তার তিনটি বিভিন্ন জন্মতারিখ জানা গেছে। মনোনয়ন লাভের আবেদন পত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার ক্ষেত্রে তিনি লিখেছেন "স্বশিক্ষিত"। এখানে প্রমানিত হয় যে সত্যের মুখোমুখি হওয়ার মতো সৎ সাহস খালেদা জিয়ার নেই। পাকিস্তানী সামরিক কর্মকর্তা লে: জেনারেল জানজুয়া খান এবং ভারতের জেনারেল অরোরা - খালেদা জিয়ার দৃস্টিতে এই দুই সামরিক জেনারেলের মধ্যে কে ছিলেন বাংলাদেশের সপক্ষে?

কারণ, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় জেনারেল জানজুয়া খান পাক-হানাদার বাহিনীতে লে: কর্নেল পদে চট্রগ্রামে কর্মরত থাকাকালে গণহত্যা, নারী ধর্ষণ ও অন্যান্য অমানবিক কার্যকলাপে জড়িত ছিল এবং তার মৃত্যুর পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার পক্ষ হতে রাস্ট্রীয় পর্যায়ে শোকবার্তা পাঠানো হয়। অন্যদিকে ভারতীয় জেনারেল অরোরা ১৯৭১ সালে সম্মিলিত মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন এবং খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তার মৃত্যুর পর সরকারীভাবে কোন শোক বার্তা পাঠানো হয়নি।

আগামীতে যা করণীয়:
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সপক্ষের সকল শক্তিগুলোর ঐক্যবদ্ধ প্রচেস্টার কোন বিকল্প নেই। লক্ষ লক্ষ শহীদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে নিম্নে বর্ণিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়:

(১) মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী দল ও ব্যক্তিকে ভোট দানে বিরত থাকা।
(২) যে রাজনৈতিক দল স্বাধীনতা বিরোধী দল বা ব্যক্তিকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে জনগণের উচিত সেই দলকে ভোটযুদ্ধে পরাজিত করা।
(৩) প্রতিটি স্কুল, কলেজ ও শিক্ষা প্রতিস্ঠানে প্রামান্য চিত্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসের উপর আলোচনা সভার আয়োজন করা।
(৪) প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে "মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর" নির্মাণ করতে হবে। প্রতিটি এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের ইতিহাস এবং একসাথে পাক-হানাদার সহযোগীদের গণবিরোধী ও অমানবিক কার্যকলাপের বিবরণ লিপিবদ্ধ করতে হবে।
(৫) বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারী কার্যালয়, বিমান বন্দর এবং রেল স্টেশনগুলোতে সুন্দরভাবে লিখতে হবে - "লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে প্রাপ্ত বাংলাদেশের মালিক জনগণ। বাংলাদেশের কোন ব্যক্তি, কোন পরিবার বা কোন দলের সম্পত্তি নয়।
(৬) সৃস্টিকর্তা বা আল্লাহ কোন ব্যক্তি বা দলকে এজেন্সি দেননি ধর্মের নাম ভাঙ্গিয়ে রাজনীতির মাধ্যমে জনগণকে শোষণ বা অত্যাচার করার জন্য। তাই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মৌল আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ধর্মের নামে রাজনীতি বন্ধ করতে হবে।
(৭) বাংলাদেশের প্রতিটি থানা বা উপজেলা পর্যায়ে পরিবেশের ভারসাম্যতা বজায় রেখে শিল্প নগরী গড়ে কার্যকরভাবে গণমূখী আর্থ-সামাজিক পরিকল্পনা নিতে হবে।

এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়িত হলে "জনগণের বাংলাদেশ" সোনার বাংলার স্বপ্নের পথ অনেকটা সুগম হবে। সম্ভব হবে সুখী সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল বাংলাদেশের নির্মাণ।

ড: তৌফিক চৌধুরী, লস এঞ্জেলেস থেকে নিউজ বাংলার জন্য তাঁর লেখাটি পাঠিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা, লেখক এবং গবেষক।

No comments: